“আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা,
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি,
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।“
কবি সুফিয়া কামালের কথায় এই যে ‘আমাদের যুগ’, ‘তোমাদের যুগ’ – এই যুগটা আসলে কি?
এই যুগটাই আসলে জেনারেশন। আমরা হরহামেশাই বলি, আমাদের জেনারাশনটা এমন, কিংবা ওদের জেনারেশনটাই আলাদা। কেন বলি? এই যে জেনারেশনে জেনারেশনে পার্থক্য - ব্যবহারে পার্থক্য, মতে পার্থক্য, চিন্তা ভাবনায় পার্থক্য - এ সবকিছুই আসলে একটা জেনারেশন থেকে অন্য একটা জেনারেশনকে এক্কেবারে আলাদা করে তোলে।
তাই জেনারেশন বলতে কাছাকাছি সময়ে জন্মানো, বেড়ে ওঠা মানবগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা একই রকম পরিবেশ, পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তাদের জীবন অতিবাহিত করেছে, বা করে আসছে। একই পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠার কারণে তাদের আচার-ব্যবহার, চিন্তা-ভাবনার ধরণও বেশ কাছাকাছি হয়। সাধারণত ১৫-২৫ বছরের কাছাকাছি সময়কালকে একটা জেনারেশন বা প্রজন্ম বলে ধরা হয়।
উনিশ শতকের পর থেকে যদি আমরা জেনারেশনগুলোকে একটু বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে বিষয়গুলো আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে।
জন্ম ১৯০১-১৯২৪ - দ্য গ্রেটেস্ট জেনারেশন (The Greatest Generatiএই জেনারেশনকে জি আই (জেনারেল ইস্যু) জেনারেশনও বলা হয়, কারণ এই জেনারেশন গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়টাতে বেড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই জেনারেশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালকে সাক্ষী করে জীবন অতিবাহিত করেছে। ফলে ক্রাইসিস বা কনফ্লিক্টের সাথে বসবাস করতে পারার একটা প্রবণতা তাদের থাকাটাই স্বাভাবিক।
জন্ম ১৯২৫-১৯৪৫ - দ্য সাইলেন্ট জেনারেশন (The Silent Generation) - যুদ্ধপরবর্তী সময়কালটাতে এই জেনারেশন তাদের শৈশব বা যৌবনকালটা কাটিয়েছে। ফলে কিছুটা হলেও আপষপ্রবণ ছিলেন এই জেনারেশনের বাহকেরা। একটা শান্তিপুর্ণ মডেস্ট লাইফ হলেই যেন চলে যাচ্ছিল ঠিকঠাক তাদের।
জন্ম ১৯৪৬-১৯৬৪ - বেবি বুমার জেনারেশন (Baby Boomer Generation) - ‘বেবি বুমার’ টার্মটাই এসেছে ‘বুম’ শব্দটা থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই হঠাৎ করেই যেন পপুলেশন বেড়ে যায়। এই প্রজন্ম দেখেছে মানুষ চাঁদে পা রেখেছে, একটা অসম্ভবকে জয় করতে দেখে বড় হওয়া এই জেনারেশন আশাবাদী হতে শিখেছে, শিখেছে ভোগবাদী হতেও।
জন্ম ১৯৬৫-১৯৮০ – জেনারেশন এক্স (Generation X) - এই জেনারেশন “বেবি বাস্টার্স” নামেও পরিচিত, কারণ হঠাৎ করেই এই সময়কালটাতে জন্মহার বুমারদের তুলনায় অনেকটাই কমে যায়। এই জেনারেশনের মধ্যে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার একটা চরম আগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়। পার্সনাল কম্পিউটারটাও দেখে নেয়া হয় এই জেনারেশনেরই প্রথম।
জন্ম ১৯৮১-১৯৯৬ – জেনারেশন ওয়াই (Generation Y) - প্রজন্মের সকলকে “মিলেনিয়ালস”ও বলা হয়। কারণ মিলেনিয়ামের সময়কালটাতে তারা তাদের এডাল্টহুডটা অতিবাহিত করে। ৯/১১ এর অভিজ্ঞতা, ইন্টারনেটের জগতে পা দেয়ার অভিজ্ঞতা, গ্রেট রেসেশনের অভিজ্ঞতাই এই প্রজন্মকে আলাদা করে তোলে। সম্ভবতঃ এই প্রজন্মই ইন্টারনেট জগতে প্রবেশের আগে এবং পরে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার মধ্যে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
জন্ম ১৯৯৭-২০১২ – জেনারেশন জেড (Generation Z) - এই জেনারেশনকে “আইজেন”ও বলা হয়, এই জেনারেশন টেকনলজির ব্যক্তিগত ব্যবহার খুব ভাল করেই রপ্ত করে ফেলেছে। স্মার্টফোন তাদের নেসেসিটি, লাক্সারি মোটেই না। শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটাই এগিয়ে থেকে এই জেনারেশন বিভিন্ন বিষয়ে যেমন উদারমনের পরিচয় দিতে পেরেছে, অন্যদিকে টেকনলজি, সোশ্যাল মিডিয়ার লাগামহীন ব্যবহার এই প্রজন্মকে একটা হতাশায় নিমজ্জিত প্রজন্মে পরিণত করেছে।
জন্ম ২০১৩-২০২৫ – জেনারেশন আলফা (Generation Alpha) - জেনারেশন জেডের পরে এই প্রজন্মকে বলা হচ্ছে একটা “নিউ স্টার্ট”। এই প্রজন্ম সিঙ্গেল পেরেন্টহুডে অভ্যস্ত হবে। পারিবারিক কাঠামো, চিন্তা-ভাবনায় ডাইভার্সিটি থাকলেও আগের জেনারেশনের তুলনায় তারা অনেক বেশি অর্থনৈতিক বৈষম্য এক্সপেরিয়েন্স করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এবার জেনারেশন জেডের এই যে একটা টেন্ডেন্সি আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তারা ঠিক শিওর না যে তারা আসলে কি করতে চায়? চাকরিক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো আসলে তাদেরকে মোটিভেটেড রাখে, কোন বিষয়গুলোই বা তাদেরকে বিমুখ করে তোলে, চাকরি ছেড়ে দিতে, কিংবা পরিবর্তনের কথা ভাবতে বাধ্য করে, এমন দশটা বিষয় নিয়ে যদি একটু আলাপ করা যায়ঃ
১। উন্নতির অভাব (Lack of Career Development/Advancement) - জেন জেডকে তাদের ক্যারিয়ারে উন্নতি করার, বা উপরে ওঠার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিতে হবে। অনশ্চয়তায় তাদের বড় অস্বস্তি বা ভয়। ইনফরমেশনের এক্সেসিবিলিটি তাদেরকে ভালনারেবল করে তোলে। ফলে তারা জানতে চায়, বুঝতে চায় সবটা।
২। অপর্যাপ্ত কম্পেন্সেশন এন্ড বেনেফিটস (Inadequate Compensation and Benefits) - ইনফরমেশনের এক্সেসিবিলিটির কারণে ভীষণ তুলনা করে এই প্রজন্ম। “ও পেলে আমি কেন পাব না” – এই মনোভাবে প্রতিনিয়তই বেটার অপরচুটির পিছনে এরা ছুটতে থাকে। তাই ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড কম্পেন্সেশন এন্ড বেনেফিটস অফার করার কোন বিকল্প আসলে নেই।
৩। উদাসীন/দায়িত্বহীন লিডার (Uncaring/Uninspiring Leaders) – এই জেনারেশন যেকোন কারণেই হোক, মোটিভেশন খোঁজে। যে কোন মানুষে, যে কোন জায়গায়। সুপারভাইজার বা বসকে দায়িত্বহীন বা আনকেয়ারিং, আনকন্সার্ন্ড দেখতে তারা পছন্দ করে না। কথায় আছে না, যে এমপ্লয়ি কোম্পানি ছেড়ে যায় না, ছেড়ে যায় বাজে সুপারভাইজার বা বস। ইট ম্যাটার্স!
৪। অর্থপূর্ণ কাজের অভাব (Lack of Meaningful Work) – জেন জেড নিজের কাজের সাথে এনগেজড বা কানেকটেড থাকতে পছন্দ করে। মোটিভেট করে না এমন কাজে এই প্রজন্মকে বেঁধে রাখা দায়। তাই ঠিক মানুষটাকে ঠিক জায়গায় বসাতে পারাটা এখন একটা চ্যালেঞ্জ।
৫। অযৌক্তিক কাজের প্রত্যাশা (Unsustainable Work Expectations) – অযৌক্তিক টার্গেট, অযৌক্তিক পার্ফরমেন্সের এক্সপেকটেশনে এই জেনারেশন রিয়্যাক্ট করে। নিজে কনভিন্সড হলেই কেবল এফোর্ট রাখে, নইলে না।
৬। কর্মক্ষেত্রে অবিশ্বস্ত/আনসাপোর্টিভ সহকর্মী (Unreliable/Unsupportive Colleagues at Work) - সিনিয়রিটি, জুনিয়রিটির চাইতে এই জেনারেশন অনেক বেশি কাউন্ট করে রিলায়েবল এবং সাপোর্টিভ মনোভাবকে। তাই টক্সিক পরিবেশ এদের ক্লান্ত করে তোলে। কর্পোরেট পলিটিক্সে এদের এদের সায় একেবারেই নেই।
৭। কর্মক্ষেত্রে নমনীয়তার অভাব (Lack of Workplace Flexibility) – ৯-৫ টার অফিস টাইম কিংবা ছকে বাঁধা অফিস টাইমেও জেন জেড বেশ বিরক্ত। বিশেষ করে কোভিড ১৯ ফেইস করে অফিস, ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে তাদেরকে আর নিয়মে বাঁধা কষ্টকরই হবে। তাই একটু নিজের মত করেই কাজ ম্যানেজ করতে তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
৮। শারিরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য/সুস্থতার জন্য সমর্থনের অভাব (Lack of Support for Health/Wellbeing) - এই জেনারেশনে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে এওয়ারনেস প্রবল। তাই ফিজিক্যাল বা মেন্টাল ওয়েলবিং তাদের আট্মোস্ট প্রায়োরিটি। খুব প্রয়োজনে আটকে না গেলে এ ব্যাপারে তারা কম্প্রমাইজ করতে নারাজ।
৯। অনিরাপদ কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ (Unsafe Workplace Environment) – আনসার্টেইন, আনসেইফ, ইনসিকিওর্ড – এই শব্দগুলোতে জেন জেড ভালনারেবল। তাই কাজের সুস্থ এবং সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
১০। অপর্যাপ্ত রিসোর্স/ইনফরমেশন (Inadequate Resource Accessibility) – কাজের ক্ষেত্রে কিংবা যেকোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রিসোর্স বা ইনফরমেশনের ঘাটটি এদেরকে ফ্রাস্ট্রেটেড করে। সহজেই আগ্রহটা হারিয়ে যায়। তাই এই দিকটাও আসলে ভেবে দেখা জরুরী।
পরিশেষে, এই বিষয়গুলোই যে কেবলমাত্র দায়ী, এটা বলা যাবে না। চাকরি ছেড়ে দেয়ার, বা পরিবর্তনের কথা ভাবার আরও অনেক কারণ নিশ্চয়ই এই জেনারেশনের আছে।
তবে এই বিষয়গুলোকে সামগ্রিক ভাবে বিবেচনায় এনে, কর্মস্থলের পরিবেশকে যথাযথ করে তুলে যদি এই জেনারেশনের কাছে নিজেদের আশাগুলোকে রাখা হয়, তাহলে এই জেনারেশন আমাদের হতাশ করবে বলে মনে হয় না।
টেকনোলজিক্যাল এডভান্সমেন্ট আমাদের আগের জেনারেশনগুলোকে এই চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে দিয়ে আসলে দেখতে চাচ্ছে, আমরা আসলেই জেন জেডের যোগ্য পূর্বসুরী কি না!
আমাদের দায়িত্ব তাদের পথ দেখানো।
আমরা তৈরী তো!!