“থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে“ – এই কথাকে সত্যি করে ছেলেদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে মেয়েরা এখন কাজে যায়। আগের চাইতে এই হার এখন অনেক বেশি। পরিবারে, সমাজে আস্তে আস্তে এই যে পরিবর্তনের হাওয়া, তা পালে লেগে জীবন তরীর দিক পরিবর্তন হচ্ছে দিনে দিনে।
দীর্ঘদিনের লালিত যে সমাজ ব্যবস্থা, তার সবটায় যে পরিবর্তন এসে গেছে, সেটা বলা যাবে না। মেয়েদের কাজে যাওয়ার ক্ষেত্রে, কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক বাঁধা আছে, তার অনেকটাই আছে আবার অদৃশ্য হয়ে, যাকে “গ্লাস সিলিং” বলা হয়। এই বাঁধাগুলো বিরাজ করে প্রতিনিয়তই, পরিবারে, সমাজে, কিন্তু তা নিয়ে আলাপ নেই, আক্ষেপ আছে শুধু।
তাই তো আমাদের অনেকেই মা হওয়ার সুখটুকু পায়, কিন্তু মুক্তিটুকু পায় না। মা হওয়া মানেই যেন নিজেকে বন্দিত্বের শিকলে বেঁধে ফেলা। দশ মাস, দশ দিন অপেক্ষা করে যাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা, তাকে দেখভাল করতে গিয়েই হয় যত বিপত্তি। ঝরে যায়, ভেঙে যায় সেই চূড়া দেখার স্বপ্ন, সাফল্যের চূড়া, যেখানে শুধু নিজের হাত ধরেই উঠতে হয়।
পরিবর্তনের হাওয়া লেগে শহুরে পরিবারগুলো এখন মানুষশূণ্য বলতে গেলে। যারা এখনও বাবা-মায়ের সাহচর্য পান, বা পাচ্ছেন, তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। পরিবারের ছোট্ট সোনার ভার দাদা-দাদী, কিংবা নানা-নানীর হাতে দেয়া গেলে তার চাইতে স্বস্তির মনে হয় আর কিছু হয় না।
কিন্তু বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা চলে না! ক’টা পরিবারের এই সৌভাগ্য হয়? ফলে দেখা যায়, পরিবারের মেয়েটাকে, মা’টাকে ছেড়ে দিতে হয় তার কাজটা, বা চাকরীটা। ভাবে হয়ত ব্রেক নিচ্ছে, এই বলে স্বান্তনা হয়ত দেয় নিজেকে, কিন্তু হয় তার আর ফেরা হয় না। অথবা, তার এই ক্যারিয়ার গ্যাপের কারণে সে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। এই পিছিয়ে পড়া পথ আর মসৃণ থাকে না তার জন্যে।
তারপরেও অভিজ্ঞ কর্মজীবী মায়েদের কিছু পরামর্শ নতুন মায়েদের কাজে ফিরতে কিছুটা হলেও ভরসা যোগাবে।
আমাদের মধ্যে যারা সদ্য মা-বাবা হয়েছেন, চাকরি করছেন, যেখানে বাঁধা ধরা অফিস টাইমিং আছে, তাদের জন্য উপকারী কিছু কথা। বিশেষ করে মায়েরা, যারা মেটারনিটি ছুটি কাটিয়ে অফিসে ফিরবেন অল্প সময়ের মধ্যেই। হাতে মাস খানিক সময় আছে, কি তার কম বা বেশি, সবারই বিষয়টা কাজে আসবে।
প্রস্তুতিটা কিন্তু শুরু করে দিতে হবে বাচ্চার বয়স তিন বা চারের পর থেকেই। মানসিক প্রস্তুতিটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কাজে ফেরার ক্ষেত্রে। কাজে ফেরার ঠিক ওই সময় টাতে মা, বাচ্চা দুজনকেই একটা সেপারাশন এংজাইটির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই একটু আগে থেকে যদি প্রস্তুতিটা শুরু করা যায়, তাতে দুজনেরই সুবিধা।
পরিবারের সাপোর্ট এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, পাশাপাশি সহকর্মীদের সাপোর্টও দরকার হয় নতুন মাকে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে। পরিবার বলতে এখানে বাচ্চার বাবার ভুমিকাও ইম্পরট্যান্ট। এই লেখায় মায়ের কথাই বেশি থাকবে, তবে মায়ের চারপাশে থাকা সবাইকেই বাড়িয়ে দিতে হবে সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার হাত।
প্রথমেই একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, প্রত্যেকটা বাচ্চা আলাদা। আমার বাচ্চা যেভাবে রেস্পন্স করে বা করেছে, অন্য একটা বাচ্চা সেটা নাও করতে পারে। কিছু ঢালাও পরামর্শ তাই কাজে আসবে না। একজন মা কিংবা বাবাকেই বুঝতে হবে তাদের বাচ্চা কোন পরিবেশে কেমন থাকে, সেই অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেবেন। বাচ্চার জন্য কোন কোন ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, সেগুলোকে এক করে তবেই সাপোর্টসিস্টেম দাঁড় করাতে হবে।
নতুন মা-বাবার জন্যে কিছু জেনারেল টিপস, এগুলো একজন নতুন মা’কে তার কাজে ফিরতে সাহায্য করবে।
নির্ধারিত ছুটির (মেটারনিটি লিভ) পরেও বাড়তি ছুটি কাটানোর কথাটা মায়ের মাথায় চলে আসে স্বাভাবিক ভাবেই। তবে ভবিষ্যতের সময়-অসময়ের কথা মাথায় রেখেই ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো। এক্ষেত্রে নিজেকে অস্বস্তিতে পড়তে হয় না প্রয়োজনের সময়।
৬ মাস পর কাজে যেহেতু ফিরতেই হবে, বাচ্চার দৈনন্দিন রুটিনে একটু একটু করে পরিবর্তন আনতে হবে বয়স চার পেরোলেই। এতে হঠাৎ কোন চেঞ্জ আসবে না। মা বাসাতে থেকেই পরিবর্তনগুলোর সাথে বাচ্চাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন। এটা হতে পারে নতুন খাবার, কিংবা বাচ্চার যত্নে নতুন মুখ।
বুকের দুধে অভ্যস্ত বাচ্চারা অনেক সময় ফিডার খেতে চায় না। তাই চার মাস পেরোলেই আস্তে আস্তে মা বুকের দুধটাই ফিডিং বটল, বা চামচে খাওয়ানো শুরু করতে পারেন।
এই সময়টাতেই মাকে বুকের দুধ জমানো এমং স্টোর করাটা শিখে নিতে হবে। বাচ্চা পর্যাপ্ত দুধ না পেলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে ফর্মুলায় অভ্যস্ত করে তোলা জরুরী।
একটা ভালো মানের ব্রেস্টমিল্ক পাম্প মাকে সাহায্য করতে পারে দুধ বের করার ক্ষেত্রে। এই প্রসেসকে সুবিধাজনক করতে মায়ের স্বাস্থ্য ও খাবারের প্রতি যত্ন নেয়া জরুরী।
বাচ্চাকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে গোসলে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। চাকরিজীবী মায়েরা অনেক সময় সকাল বা সন্ধ্যেটা বেছে নিতে চান। যখনি হোক, সেটা প্রতিদিনের রুটিন করে ফেললে বাচ্চার ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয় থাকবে না।
পরিবারের যারা সাপোর্ট হবেন মায়ের অনুপস্থিতিতে, এক একদিন তাদের হাতে খাওয়া, গোসল করা, ন্যাপি চেঞ্জ করা, ঘুম পাড়ানো – এই কাজগুলো করলে তারাও অভ্যস্ত হয়ে যাবে বাচ্চার চাহিদার সাথে। মা-ও নিশ্চিন্ত হতে পারবেন।
যদি পরিবারের বাইরের কেউ কেয়ার গিভার হিসেবে আসে, তাকেও এখনি শুরু করা উচিত, যাতে সে মায়ের এবং বাচ্চার চাহিদা বুঝে সেগুলো নিয়ম করে করতে পারে।
কেয়ার গিভারের পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিয়ে তাকে বাচ্চার উপযোগী করে গড়ে তোলা জরুরী।
অফিসে যদি বেবিকেয়ার ফ্যাসিলিটি থাকে, এবং আপনি বেবিকে সংগে করে অফিসে আসতে চান, সেক্ষেত্রেও একজন কেয়ার গিভারের প্রয়োজন। পাশাপাশি অফিসে সহকর্মীদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন সেখানকার ফ্যাসিলিটি সম্পর্কে।
অফিসকে আগে থেকে নোটিফাই করে রাখা ভালো, সেক্ষেত্রে অফিসও তাদের প্রস্তুতিটা রাখতে পারে।
যদি নিজ বাসায় না থাকেন, সেক্ষেত্রে অফিসের কাছে বাসা নেয়াকেও অনেকে সুবিধাজনক মনে করেন। প্রয়োজনে অল্প সময়ে বাসায় ফেরার সুবিধার পাশাপাশি লাঞ্চ ব্রেকটাকে কাজে লাগানো যায় বেবির সাথে থাকার জন্য।
সেক্ষেত্রে বাসা শিফটের কাজটাও এই শেষ তিন/চার মাসের ভিতরে করে ফেলাটা জরুরী।
বাচ্চার বয়স ৬ মাস হয়ে গেলে বুকের দুধের পাশাপাশি তার বাড়তি খাবার শুরু হয়। কিছু আগে থেকে তাই একটু একটু করে নতুন নতুন খাবার শুরু করা যেতে পারে। সব খাবার একসাথে শুরু না করে আস্তে আস্তে একটা একটা করে করলে বাচ্চার জন্য সহজ হয় অভ্যস্ত হতে।
বাড়তি খাবার তৈরি ও সংরক্ষণের বিষয়টাও পরিবারের যিনি বাচ্চার সাপোর্ট হচ্ছেন, তাকে শিখিয়ে দেয়া জরুরী।
মা-বাবা যদি মনে করেন, বাচ্চার খাবার রান্না করে আলাদা আলাদা বক্স করে, তাতে লেবেল করে ফ্রীজে রেখে দিতে পারেন।
বাচ্চার টিকার কার্ড মেইন্টেইন করতে হবে, যাতে সময়মত সে তার সব টিকা পায়।
বাচ্চার ডায়েট চার্টটা প্রয়োজনে লিখে রাখা যেতে পারে। তাতে অন্যদের খাবারে সময়, খাবারের ধরণ বুঝতে সুবিধা হবে।
কাজে ফেরার প্ল্যানটা আগে ভাগেই করে ফেললে ভালো হয়। শুরুতে অফিস টাইম যাতে কিছুটা ফ্লেক্সিবল থাকে, এ ব্যাপারে সহকর্মী, বিশেষ করে কোম্পানী এইচ আর-এ যিনি আছেন তার, এবং লাইন ম্যানেজারের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
কোন কাজে, বা সিদ্ধান্তে পার্টনারকে, এমনকি পরিবারকে এনগেজ করতে দ্বিধা করা যাবে না কিছুতেই। খোলাখুলি কথা বলে বাচ্চাদের ব্যাপারে নিজেদের প্ল্যান সেট করতে হবে।
মা হিসাবে বাচ্চা রেখে কাজে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তা, দ্বিধা, অপরাধবোধ ঝেড়ে ফেলতে হবে। নিজেদের মধ্যে ভালো একটা বোঝাপড়া, একটা সামগ্রিক প্ল্যান সবকিছুকে সহজ করে দিতে পারে।
নতুন মায়ের জন্য এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ, একই সাথে সংবেদনশীল। বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে না দেখে এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মনে করলে সহজ হবে কাজে ফিরতে। ওয়ার্কফোর্সে এখন অনেক ফিমেইল মেম্বার আছেন, আপনি একা নন মোটেই।
https://www.webmd, খুবই উপকারী একটা সাইট, যারা মা হতে চাচ্ছেন, বা নতুন মা, কি পুরাতন, এখান থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারেন নিজের ও বাচ্চার জন্যে।
আবারও সেই একই কথা, প্রতিটা বাচ্চা আলাদা, মা আলাদা, স্বামী-স্ত্রী, পরিবার সব আলাদা। তাই নতুন মা হিসাবে নিজেকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে গুছিয়ে আবার সবটা শুরু করার। বাচ্চার মা এবং বাবা দুজনকেই নিজেদেরকে সময় দিয়ে আলাপ আলোচনা করে সুন্দর একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের সাপোর্টেই কেবল পথ চলাটা সহজ হবে।
সবার জন্য শুভকামনা রইল।
Loving our job doesn’t make us any less of a mom...❤️