#টিকলি
*
আমার না একখান টিকলির খুব শখ আছিলো, স্বর্ণের টিকলি।
বিয়া ঠিক হইলো যহন, সকলে কেনাকাটা নিয়া ব্যস্ত, আমি উনারে ফোন দিয়া কইছিলাম, আমারে একখান সোনার টিকলি দিয়েন। বুঝায়ে কইছিলাম, ঝাপটা, নথ সিটি হইলেও সমস্যা নাই, ওইগুলান পরে আর আমার পরা হইবো না। কিন্তু টিকলিখান আমি পরতে চাই।
আমার বোনের বিয়া হইবো, আপনেগো পরিবারের বিয়াশাদী থাকবো। এছাড়াও আমাগো বিবাহবার্ষিকী, ঈদে, পার্বণে - আমার খুব সাধ আমি খুব কইরা সাজি। সবসময় তো আর পারুম না, প্রথম প্রথম!
উনি মুখ ভার কইরা কইয়া দিছিলেন, দেহো, এইগুলা আমার মা, খালা, বোন দেখতাছে। আমি এইগুলা নিয়ে কথা বলা পছন্দ করি না। এখন তাদের শখমতো চলুক, তোমার শখ তুমি পরে পুরাণ করতে পারবা। তাদের ঘরের ছেলের বিয়া, তারা ভালো বুইঝাই করবো, যা করবো।
মন ভার হইছিলো অনেক। নিজের বাপ-মায়েরে যে কমু, সেই উপায় নাই। হেরাই আমার মেহমান। নিজে চাকরি কইরা যে টাকা পুঁজি করছি, তা দিয়া ছেলেপক্ষের কেনাকাটা, বিয়ার অনুষ্ঠান, তাও চলে না। শখ পুরাণ যেন বিলাসিতা!
মনে মনে আশা করছিলাম, উনি একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবেন! আমার কোন ইচ্ছা উনি অপূরাণ রাখবেন না, এইটা আমি মানি। মানুষটা আমারে খুশি দেখতে চান। হয়ত কথা দেন নাই, কিন্তু উনি ভাইবা দেখবেন, আমি জানি। আমার মতো উনিও নিজের বিয়ার খরচ নিজে যোগাইতাছেন, এইটাও জানি। তারপরেও, উনি আমারে পাওনের লাইগা, খুশি করনের লাইগা ম্যালা কিছু করছেন এর আগে! আমি উনারে চিনি।
বিয়ার দিন পার্লারে যাওনের আগে তারে ফোন দিয়া মাথার চুলের সাজের জিনিসগুলা চাইছিলাম। চুলের লগে, ওড়নার লগে তারা সেট কইরা দিবো, সুন্দর লাগবো। উনি খুব রাগ হইলেন আমার কথায়, কইলেন, আমাগো বাড়ির রীতি হইলো, আমাগো মা, খালা, যারা আছেন ময়-মুরুব্বী, হেরা বিয়ার কনেরে গয়না পরাইবো, নিজ হাতে। তুমি এত অস্থির হইয়ো না তো! দেখতে তো পাইবাই, কি পাইলা, না পাইলা!
আমি খুব লজ্জা পাইলাম। আমি কি সেই কথাখান তুলছি! আমি শুধু চুলের জিনিসগুলান চাইছি, কেন, তাও খুইলা কইছি। আজকের দিন এইভাবে উনি কইতে পারলেন! চোখ দিয়া পানি বাইয়া পড়তে লাগলো, আমিও সামলাইলাম না নিজেরে। যেই পানি আমি সাইধা, দাওয়াত দিয়া আনছি, তারে বাঁধ দিমু ক্যান!
এমনে কানলে তোমার সাজ ভালা হইবো না বুবু, তোমারে পেত্নীর লাহান লাগবো,ভালা হইবো? কাইন্দো না, দুলাভাই তো ঠিকই কইতাছে! হের বাড়ির লোকে কইবো না, হেয় বিয়ার আগেই বউপাগল!
তুমি একটু মাইনা নাও। এত কিছু মানলা, তার কথা ভাইবা তোমার এত সাধের চাকরিখান ছাড়লা। আমাগো কারও কথা ভাবলা না, এখন কি বুইঝা চোখের পানি ফেলতাছো? মুখ ধুইয়া আসো যাও, চোখের পানি ফেলনের দিন সামনে আরও পাইবা।
এখন একটু হাসো তো দেহি!
*
বিয়ার তত্ত্বে টিকলি আছিলো, তয় সেইখান সোনার না।
আমি মন খারাপ করি নাই এই লইয়া তহন আর। উনার নানী আমারে গলায় হার পরাইলেন, মায়ে হাতে চুড়ি পরাইলেন, খালায় কানের দুল, বোনেরা কেউ টিকলি, কেউ ঝাপটা, কেউ নথ পরাইলেন, আমার নিজেরে রাণী রাণী মনে হইতাছিলো। কেউ আমারে যত্ন কইরা গয়না পরাইতেছে, এই সুখে আমি সুখী আছিলাম।
কেউ আমারে যত্ন কইরা সাজাইবো, মুখে তুইলা খাওয়াইবো, ব্যাথা পাইলে উহ! কইয়া উঠবো, ঘুমন্ত আমার মুখের দিকে চাইয়া থাকবো, এই সকলের লোভে পইড়াই তো সব ছাইড়া তার হাতখান ধরছিলাম।
ভাবছিলাম, সত্যই একদিন এইগুলানের সাথে আমার পরিচয় হইবো। এতকাল খালি শুইনা শুইনা দিন পার করছি। চেহারা সুরাত ভালা আছিলো। আমারে চাওনের লোকের অভাব আছিলো না।
হইলে কি? বিশ্বাস কইরা নিজেরে তুইলা দেওনের লাইগা ভাবছি, নিজের একজন আইলে হেয় আমারে ঠিক বুঝবো! আমার চাইয়া নেওনের কিছুই থাকবো না। হেয় আমার চোখের ভাষা বুঝবো। হের কাছে নিজেরে খুচরো পয়সার লাহান জমা করণে আমার লজ্জার কিছুই নাই।
উনার লগে পরিচয় হইলে মানুষটারে আমার মনে হইছিলো, মানুষটা আমারে ছাইড়া যাইবো না। আমারে আগলাইয়া রাখবো। এই জীবনে যা কিছু পাইলাম না, হেয় আমারে সব দিবো। তার মুখের কথায় আমি আমার সব ছাইড়া তার ঘরে চইলা গেলাম সিটির টিকলি মাথায় দিয়া।
সেই ঘরে গিয়া আমার লাইগা যা যা অপেক্ষায় আছিল, তা আমি কোনোদিন ভাইবা দেখি নাই। আমি জাইনা গেলাম, আমি বউ, আমার কাজ ঘর দেইখা রাখা, আমার কাজ তাগোরে খুশি রাখা। তাগোরে খুশি রাখতে গিয়া যদি নিজেরে দু:খ পোহাইতে হয়, সেই দু:খ হাসিমুখে মাইনা নেওনের নামই সংসার। সংসারে বউরা কথা কয় না, তাগোর কাজ কথা শুইনা চলা, কথা মাইনা চলা।
আমার একখানমাত্র বোনের বিয়ার সময় আমার আবার সেই একখান টিকলির কথা মনে পইড়া গেল। ভয়ে ভয়ে তারে আবার কইলাম টিকলিখান যদি সোনার দিতেন! এইবার আর অল্প কথায় সারলো না। অনেক বকাবাদ্যি শুইনা পরে আমি জেদ ধরলাম। আমি যেন নিজেই মাইনা নিতে পারতেছিলাম না, আমার শখে তার সাথ নাই।
ভালোবাসার বশ ভালা হয়, জেদের বশ ভালা হয় না। উনি আমার জেদের কাছে হাইরা গিয়া আমারে টাকা দিলেন টিকলি কিনবার, সোনার টিকলি। আমি সব ভুইলা, চোখের পানি শুকাইয়া দোকানে গেলাম। যাইয়া শুনি এই টাকায় টিকলি হইবো না, হইলেও খুব পাতলা, ভালা দেখাইবো না।
আমার তো নিজের জমা বইলা কিছুই নাই। উনারে আবার বাড়তি টাকার কথা কইয়া কথা শুনবার মন চাইলো না। সেইদিন ঠিক কইরা নিলাম, যদি কোনোকালে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে পারি, সেইদিন টিকলি আমি নিজেরে নিজে কিইনা দিয়া সাজাইয়া রাখুম। কারো হাতে নিজেরে সাজানোর ভার আর ছাইড়া দিয়া কষ্ট করবার দরকার নাই।
দিন গড়াইলো। একদিন, দুইদিন না, বছরের পর বছর। উনাগো বাড়ির মেয়ের বিয়া, উনার বোন লাগে সম্পর্কের দিক দিয়া। সেই বিয়ায় আমারে যাওনে তারা বারণ দিলো। তাগো মনে ভয়, আমি যদি তাগো মাইয়ার বিয়া ভাইংগা দেই, কি তাগো লইয়া কোনো খারাপ কথা কই!
আমি ভাবি, তারা আমারে তাগো লাহানই ভাবে তাইলে! তারা এইটা ভাইবা দেখে না, আমি কি কি সহ্য কইরা হাসি মুখে ঘুইরা বেড়াই!
বিয়ার দাওয়াতও নাই, আমার টিকলির কষ্টও নাই।
*
দিনগুলান সহজ আছিলো না।
আমি এক ভাইবা তার ঘরে আসছি। ভাবতাম যেই ঘরে আমার ছায়া পড়বো, সেই ঘরে আলোর অভাব হইবো না। বাবার ঘরে ম্যালা কষ্ট করছি, ঠিক, কিন্তু শান্তি আছিলো।
ঝগড়া কি, বুঝতাম না। মা খালি হাসতো, পাড়ায় সকলের সাথে ভালা সম্পর্ক আছিলো। কেউ ডাক্তার দেখাইবো, আমার মা; কেউ টিউশানি পড়াইবো, আমার মা; কেউ বিয়ার জন্য পাত্র-পাত্রী খুজবো, আমার মা। সেই মা আমারে ঝগড়া শিখাইবো, সংসারের কুটকাচালি শিখাইবো!
নিজের পছন্দের বিয়া আমার। মা-বোনের অনেক চিন্তা আছিলো, আমি পাত্তা দেই নাই তখন। তারা আমারে ঠিক চিনছিলো, আমি চিনি নাই। আমি কি এখনও আমারে চিনি? চিনলে কি আর এই দিন দেখেও চুপ থাকি!
আমি চুপ থাকতে শিখে গেলাম, তাতে সকলেরই শান্তি হইলো। বিয়ার পাঁচ বছরের মাথায় আমাগো ঘর আলো কইরা আমাগো সোনার টুকরা ছেলে আসলো। মা হইয়া আমি যেন বুঝলাম, আরও চুপ থাকা শিখবার পারলে আরও ভালা হইবো। আগে একজন আছিলাম , এখন দুইজন - মায়ের সাথে ছা। নিজের কারণে তার দু:খ হোউক, এমন ভাববার শিখায় নাই আমার মা।
আমার ছেলের পাঁচ বছরের জন্মদিনে অনুষ্ঠান করবার ইচ্ছা করলাম। উনি মত দিলেন, আয়োজনও করলেন। যারে যারে দাওয়াত দিবার চাইলাম, উনি না করলেন না। সেই অনুষ্ঠানেরে উপলক্ষ্য কইরা আমার আবার সেই টিকলিখানের কথা মনে পইড়া গেলো। সোনার দাম ততদিনে আরও অনেক বাড়তি।
আমি মনে মনে কই, এতো কিছু ভুইলা গেলা, একখান টিকলির কথা ভুললা না! তুমি এমন ক্যান! আমি এমনই। ছাড়তে ছাড়তে সবই তো ছাড়ছি, একখান টিকলি, একখান হারমোনিয়াম, তার কাছে কিছুই না। তাও যেন আমি নিজের মনেরে বাঁধ দিবার পারলাম না। আমার চোক্ষে পানি দেইখা উনি কইলেন, এত কিছুর পরেও তোমার মন পাইলাম না কুসুম!
আমি কইলাম, আমারে তো পাইছেন! আমি দু:খে যেমন কান্দি, আনন্দেও কান্দি। ধইরাই নেন, এই চোক্ষের পানি আনন্দের। উনি খুশি হইলেন।
রাইতের অন্ধকারে যখন আর কিছুই দেখা যায় না, তখন নিজেরে কইলাম, দিন ফিরলে নিজেরে আমি এইগুলান দিয়া খুশি করতে চাই। আমার খুশির দায়িত্ব আমি যার হাতে দিয়া নিশ্চিন্ত হইতে চাইছি, সে আমারে মাপছে অন্য কিছু দিয়া। এইগুলান তার কাছে অতি আবশ্যক কিছু না। এইগুলান না হইলে জীবন থাইমা যায় না কারো। আমার নাকি বুঝ কম, জিদ বেশি। মাইয়া মানুষের জিদ থাকা ভালা কথা না।
হয়ত তাই! আমি একদিক দিয়ে যেমন জেদি আছিলাম , অন্য দিক দিয়া বোকাও আছিলাম! চালাক মানুষ জেদি হইলে অনেক দূর যায়। কিন্তু বোকা মানুষ জিদ নিয়া বইসা থাকলে মানুষ খালি তারে নিয়া খেলে, মানুষ বইলাই ভাবে না হয়তো! জীবন আমারে নিয়া খেলতাছিলো। ততোদিন আমি শুধু দেইখাই গেছি, কিছুই কই নাই।
অনেক অনেক বছর বাদে আমার কিন্তু দিন ঘুরছিলো! বিয়ার সময় হাত ভইরা মেহেদী পরতে পারি নাই, নিজেরে একখান টিকলি কিইনা দিবার পারি নাই। শখ আছিলো একদিন আমার অনেক অনেক শাড়ি থাকবো, এক শাড়ি একবার পইরা পরের বার পরবার জন্য বৎসর চইলা যাইব, তাও সেই শাড়িদের অপেক্ষাকরণ লাগবো, কবে আমার সময় হইবো তারে গায়ে জড়ানের।
সেই সময়ও কিন্তু জীবনে চইলা আসে, কিন্তু জীবন তো আর কম খেলা জানে না!
*
একটা সময়ে আইসা আমারে চাকরি করতে না দেওয়া মানুষটাই আমারে চাকরি করবার কথা কইলো।
আমি তখন সেই পথ থেইকা অনেক দূরে ছিটকাইয়া পড়ছি। আমাগো কালচারে কিন্তু ক্যারিয়ারে গ্যাপটা ভালো ভাবে দেখে না কোম্পানীর কর্তারা! ভাবে এরে দিয়া হইবো না, কন্সিসটেন্সি নাই, কি যেই নিজের পরিবার ম্যানেজ করতে পারে না, সেই আবার চাকরি করবে ক্যামনে? মাইয়া মানুষের চাকরি বইলা কথা!
আমি বুঝছিলাম, আমারে আবার শূণ্য থেইকা শুরু করণ লাগবো, কিন্তু আমি ভয় পাই নাই। আমি জানতাম, আমি চেষ্টা করলে না পারার কিছুই নাই, আমি আমারে বিশ্বাস করছিলাম। আর তারে রাজি হইতে দেইখা আমি আর ডাইনে, বাঁয়ে চিন্তা করি নাই, একখানে শুরু কইরা দিছিলাম।
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখার শিক্ষাখান মায়ে দিছিলো। বই পড়তাম অনেক। অনেক কিছু মাইনা নিয়া বাইচা থাকলেও মনে মনে নিজেরে প্রস্তুত রাখছিলাম, সুযোগ পাইলে আমি একদিন সব পোষায়ে নিবো।
নিজের প্রাইস, নিজের প্রাইড, নিজের প্রায়োরিটিরে একদিন ধুলায় মিশায়ে দিয়া আমি যে ঠিক করি নাই, সেইটা জীবন আমারে চোক্ষে আঙ্গুল দিয়া বুঝাইছে। সেই জীবন আমারে যখন সুযোগখান দিলোই, আমি যেন শিকল ছেঁড়া পাখির মত উইড়া যাইতে চাইলাম।
প্রায় দশ বছর বাদে শূণ্য থেইকা শুরু কইরা হইলেও আমি কিছুটা হালে পানি পাইলাম। ততদিনে অনেক কিছু জীবন থেইকা হারায়ে ফেলছি, অনেক ক্ষতের জন্ম হইছে, কেউ মলম লাগায় নাই। আমি নিজেরে মলম লাগানের কাজখান খুব যত্ন কইরা করছি।
ঈদ আসলে হাত ভইরা মেহেদী লাগাইছি। চোক্ষে ভালোই লাগলেও মন ভরে নাই। আমি তো চাইছি সেই মানুষখান আমার মেহেদি পরা হাত দুইখান ছুঁইয়া ছুঁইয়া দেখবো, আমার হাত দুইখান নিজের গালে ঠেকাইয়া কইবো, কুসুম, তুমি আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান জিনিস, যা আমি নিজের কইরা পাইছি। আমি আমার আল্লাহ্র কাছে ঋণী, আমি তোমার কাছে ঋণী।
আমি তার লগে রাত জাইগা গল্প করবার চাইছি, তার লগে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজবার চাইছি, তারে গান গাইয়া শুনাইবার চাইছি। নিজেরে তার হাতে তুইলা দেওনের পর, আমার আর কিছু আমার নিকট অবশিষ্ট থাকুক, সেইটা আমি চাই নাই। কিন্তু আমি দেখি, আমারে সেয় নেয় নাই আমার মতোন কইরা! আমি শুণ্যে পইড়া আছি, আর দিন চইলা যাইতেছে। সময়ের কাজ অসময়ে কি আর হয়!
আমার হাতে টাকা আসে, টাকা চইলা যায়। আমি সংসারের সকলরে সাজাই। আমি আমার চাইরপাশের সকলরে সাজাই। নিজেরে সাজাইতে গিয়া দেখি, আর সময় নাই......! আমি শাড়ি কিইনা আলমারি ভর্তি করি, কিন্তু আমার শাড়ি পইরা যাওনের জায়গারা আর নাই।
নিজেরে একখান টিকলিও হয়ত বানায় দিবার পারতাম এখন আমি, কিন্তু সেই টিকলিখান কই পরি! টিকলিখান পইরা তার চোক্ষের সামনে থাকলে যদি সেয় খুশি হইতো, আমি হয়তো সেইখানও করতে রাজী আছিলাম!
আমার শখ হয় বিয়ার শাড়িখানরে একবার পরি। লজ্জায় পরবার পারি না। আর মানুষ না হয় হাসবো, কিন্তু সেয়! সেয়ও কি হাসবো! বুঝবো না আমারে!
কত ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া থাকে জীবনে, কিন্তু বাস্তবে তারে আনা যায় না। মাঝখান থেইকা সময় চইলা যায় তার নিজের নিয়মে। পিছনে ফিইরা তাকাইলে খালি মনে হয়, কতো অপচয়ের দিন!
ক্যান করছিলাম এতো অপচয়, কার জন্য করছিলাম? উত্তর মিলাইবার পারি না।
আস্তে আস্তে চুলে পাক ধরে।
ছেলেটা বড় হয়ে যায়।
*
আমারে হাসলে যে এতখানি সুন্দর দেখাইতো, সেইটা আমি জানতাম না।
কেউ যে কখনও কয় নাই এই কথাখান আমারে, তা কিন্তু না! আমি অন্যের কথায় ভুলি নাই ততদিনেও। মুখ টিইপা হাসছি। প্রাণ খুইলা যে হাসা যায়, প্রাণ খুইলা যে বাঁইচা থাকা যায়, সে আমি বুঝতাম না।
আমি খুব ভয় পাইতাম। আমার মানুষেরে বড় ভয়। মানুষই পারে মানুষকে সুখী রাখতে, আমার সেই মানুষই পারে মানুষরে দুঃখের অতল গহবরে তলাইয়া দিতে। আমরা কই, এজাইল হইতে না পারলে তার পক্ষে টিইকা থাকা কঠিন। আমি কই, না। আগে ফ্র্যাজাইল হইতে হইবো। ‘ফ্র্যাজাইলিটি’ মানেই আমি দূর্বল, সেইটা না। আমি ফ্র্যাজাইল মানে, আমি অথেনটিক। আমারে ডীল করণে কোনো ট্রিক লাগবো না। একটু খানি যত্ন নিলেই, একটু খানি ভালোবাসলেই আমারে পাওন যাইবো।
এইটারেই আমার চাইরপাশের মানুষ আমার জন্য কঠিন কইরা তুললো। আমারে বশ করণের লাইগা, আমারে বাগ মানানোর লাইগা তারা সকলে আমার চারিপাশে শিকল তুইলা দিলো, আমারে বিধি নিষেধের বেড়াজালে বাইন্ধা, নানান রকমে লেবেলে মুইড়া আমারে নিজের মতো কইরা জাজ কইরা ছাইড়া দিলো। দিন এমন যে, এতো কিছুর পরেও এখন আমারেও প্রমাণ করতে হইবো, আমি ভুল আছিলাম। আর সবাই ঠিক আছিলো।
কিন্তু আমার ফ্যাজাইলিটি আমারে শিখাইলো “বিদ্রোহী মানে কাউকে না মানা নয়। যা বুঝি না, তা মাথা উঁচু করে বুঝি না বলা - নজরুল ইসলাম”। আমি এই 'না' খান খুব উচ্চ গলায় কইতে শিইখা গেলাম। আমি মন খুইলা হাসতে শিইখা গেলাম। আমি জানলাম, আমি-ই একমাত্র, যে আমারে জাজ করবার পারি। বাকিরা ভীষণ অযাচিত, তাগোরে পাত্তা দেওনের কিছু নাই।
আমি সকলের কাছে দূর্বোধ্য হইয়া উঠলাম। এতে আমার কষ্ট কিছুই না, তয় দুঃখ আছে। আমারে তারা কাজে লাগাইলো না। আমারে তারা পায়ে ঠেললো ভুল বুইঝা। জীবনে একটা সময়ে আমরা নিজেরে বুঝানোর লাইগা উইঠা পইড়া লাগি, আবার সেই জীবনেই এমন একখান সময় আইসা যায়, যখন আর বুঝাইতে ইচ্ছাখান করে না। মনে হয়, আমারে হারাইয়া ক্ষতি যা, তা তোমার, আমার না। সেইটা বুঝনের কাজখানও তোমার, আমার না।
যেই টিকলিখান আমার হইলো না, যেই টিকলিখান সেয় আমারে দেয় নাই দেইখা আমি এতখানি কষ্ট পাইলাম, সেই টিকলিখানরে কিন্তু আমিও আমারে দিই নাই! আমি ভাবছি, কি হইবো এখন টিকলি দিয়া? দিন তো গেছেই! দিন কি আসলেই যায়? দিন যদি যাইতোই, তাইলে কুসুম, তুমি এখনও ক্যান কষ্টখান পাইতেছো? এখনও ক্যান তোমার গলায় তোমার তার জন্য এত অভিমানের সুর! তুমি নিজেও কি তোমারে ঠকাও নাই!
সত্যি যদি বলি, আমি আসলে টিকলিখান বানাইতে দিতে গেছিলাম দোকানে। যাইয়া দেখি, সোনার দাম ভরিতে এক লক্ষেরও বেশি! শুইনা মনে হইতেছিলো, আমার পায়ের নীচে আর মাটিটুক নাই যেন! ক্যান আমি তারে জোর খাটাই নাই? ক্যান আমি নিজেরে জোর খাটাইনাই? ক্যান আমি সময় থাকতে নিজেরে নিজের প্রাপ্যখান বুঝাইয়া দেইনাই? তাইলে ক্যান আমি আজকে আইসা নিজে এত দুঃখ বইয়া বেড়াই?
আমি কই কি! তোমরা সময় থাকতে নিজেরে ভালো খান বাইসো। তোমারে ক্যামনে ভালোবাসন লাগবো, সেইখান তুমি ঠিক কইরো। তুমি তোমার চারিপাশের মানুষেরে সেইখান বুঝানের চেষ্টা কইরো। বিশেষ কইরা, তুমি যারে তোমার জীবনসঙ্গী বানাইবা, তারে। তুমি না কইয়া দিলে, কেউ তোমারে বুঝবো না আসলে। সবাই যে যার চোখ দিয়া দুনিয়াখানরে দেখে, এইটাই জগতের নিয়ম।
ভালোবাইসা, নিজের পছন্দে বিয়া করলে বিয়ার আগেই এই সকল কথা একজন আর একজনের লগে শেয়ার কইরো। মনে পুইষা রাখলে সে বুইঝা নিবো, এইটা একটা মিথ। চোখের ভাষা হয়ত আছে, কিন্তু সেইটা পড়বার ক্ষমতা আল্লাহ্ কাউরে দেন নাই। তুমি-ই একমাত্র তোমার বন্ধু, আর কেউ না।
আমি কিন্তু টিকলিখানের আশা ছাইড়া দিই নাই! আমার বাবা আমার শখ পূরণ করে নাই, সে পূরণ করে নাই, আমি নিজে পূরণ করি নাই, সত্যি। কিন্তু আমার তো একখান সোনার টুকরা ছেলে আছে। হইতেও তো পারে, সে আমার ইচ্ছাখানরে পূরণ কইরা দিলো! সে আমার গল্পখানরে মনের ভুলে পইড়া দেখলো, হইতেও তো পারে!
পঞ্চাশ পার কইরা কেউ যদি আমারে তোমরা দেখো, টিকলি মাথায় দিয়া আমি ছেলের বউ ঘরে আনতে যাইতেছি, তোমরা হাইসো না কিন্তু! লাল একখান বেনারসি পইরা, দুই হাত ভর্তি কইরা মেহেদী পইরা, এক শরীর গয়না পইরা আমারে যদি দেখো আমি তোমাদের সামনে খাড়াইছি, ধইরা নিও, সেই আমারে তোমরা অনেক অনেক আগে থেইকা চিনতা। দেখা হয় নাই তোমাগো সকলের সাথে তখন, আইজ দেখা হইলো, টিকলিখান মাথায় দিয়া, এক গাল হাসি মাইখা।
সাথে এও জাইনো, অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার! কথাখান আমার না, রবিবাবুর।